Tuesday 13 March 2018

উচ্চশিক্ষায় টি-টোয়েন্টিসুলভ তাণ্ডবলীলা


সম্প্রতি জেলার ও রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অকৃতকার্যতার অস্বাভাবিক হার বৃদ্ধি প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের মাথাব্যথার কারন হয়েছে। এই বিষয়ে সব দায় শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে না চাপিয়ে একটু অন্য ভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী কমিশন (ইউজিসি)-র সুপারিশে এরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অধীনস্ত কলেজগুলিতে সম্প্রতি এক নতুন ধরণের পাঠক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হয়েছে। ইউজিসি এর একটি গালভরা নাম দিয়েছে, ‘চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম’ (সিবিসিএস) যার পঠনপাঠন পরিচালিত হবে সেমিস্টার পদ্ধতিতে এবং সেমিস্টার শেষে পরীক্ষার মূল্যায়ন হবে কিউমুলেটিভ গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ (সিজিপিএ) এর ভিত্তিতে। ইউজিসি’র মতে এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী যেকোন বিষয় নিয়ে পড়তে পারবে। যেমন একজন ইতিহাসের শিক্ষার্থী  ইচ্ছা করলে গণিত নিতে পারবে বা একজন পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থী মনে করলে ইতিহাস বা সাহিত্যের কোর্স নিতে পারবে। ইউজিসি এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্তর্বিভাগীয় চর্চাকে উৎসাহিত করতে চেয়েছে এবং ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করে তোলার লক্ষ্য সামনে রেখেছ। উদ্দেশ্যটি আপাতদৃষ্টিতে সাধু বলেই মনে হয়। তবে অনেকেই এর মধ্যে সিঁদুরে মেঘ দেখছেনআশঙ্কার এই যে এর মাধ্যমে ভারতের শিক্ষার সুবৃহৎ বাজারটিকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছে উন্মুক্ত করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে না তো! বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ঐ ব্যবস্থা ইতিপূর্বেই চালু হয়েছে। ভারতে সরকারী উদ্যোগে এই ব্যবস্থা চালু হলে তাদের এদেশে এসে শিক্ষাব্যবসা শুরু করতে সুবিধা হবে। কে না জানে ভারত এখন যথেষ্ট ব্যবসাবান্ধব দেশ! ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের প্রতিবেদন অনুযায়ী এবছর ভারতের স্থান বিশ্বে ১০০ তম, গত বছরে যা ছিল ১৩০।

একথা সত্যি যে আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষা মানচিত্র ভারতের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও খুঁজে পাওয়া মুসকিল।এমনকি এশিয়ার প্রথম ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এই বছর ভারতের মাত্র ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে যার অধিকাংশই আইআইটি’র মত এলিট প্রতিষ্ঠান, ভারতে উচ্চশিক্ষায় ব্যায়ের সিংহভাগ যাদের জন্য বরাদ্দএনিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই যে ভারতীয় বিশ্ববিবিদ্যালয়গুলির অধোগতির মূল কারন উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব, শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের মেধার অভাব কিম্বা শিক্ষাদানের মান নয়। যদি তাই হত তাহলে ভারতীয় শিক্ষক, গবেষক ও বা শিক্ষার্থীরা বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আদৃত হতেন না বা গুগল-মাইক্রসফ্‌টের মত প্রতিষ্টানের সর্বোচ্চ স্তরে ভারতীয়দের দেখা যেত না।

ইউজিসি প্রস্তাবিত এই নতুন পাঠক্রমের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল একে বাস্তবায়িত করতে উন্নত পরিকাঠামো  একান্তভাবে জরুরীকমিশন তার প্রস্তাবে সেকথা স্বীকারও করেছে। কলেজগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে ইউজিসি কি আদৌ যত্নশীল? উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রিয় সরকারের বাজেট বরাদ্দ কি আদৌ বেড়েছে? তা না করে এই নতুন পাঠক্রমেকে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া কি তাদের ভবিষ্যত নিয়ে ছেলেখেলা নয়? গোটা বিষয়টি যে কতটা হাস্যকর তা কয়েকটি দিক খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।

এই পাঠক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা থাকবে নিজেদের পছন্দমত বিষয় নির্বাচনের। কিন্তু সমস্যা হল সব কলেজে সব বিষয়ে পঠনপাঠনের সুযোগ নাও থাকতে পারে। বড় কলেজে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সামনে যতগুলি পছন্দ থাকবে ছোট কলেজে ভর্তি হলে সেই পছন্দ যে সংকুচিত হবে তা বলাই বাহুল্য। এমনকি বড় কলেজগুলিও শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয় দিতে অক্ষম পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে। ছোট কলেজগুলির অবস্থা আরও করুণকারন সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক একটি বিভাগ চলে হয় এক-দু জন মাত্র স্থায়ী শিক্ষক নিয়ে, কখনও বা স্থায়ী শিক্ষক ছাড়া আংশিক সময়ের শিক্ষক বা অতিথি শিক্ষক নিয়ে। এই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্র প্রচলিত। ফলে ছাত্রদের পছন্দ মত বিষয় নির্বাচন কাগজে কলমেই  আছে বা থাকবে যদি না পর্যাপ্ত শিক্ষক নিযুক্ত করা যায় কলেজগুলিতে। অদূর ভবিষ্যতে কলেজগুলিতে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে অতি আশাবাদীরাও তা মনে করেননা।

ধরে নেওয়া যাক একজন শিক্ষার্থী একটি তথাকথিত বড় কলেজে ভর্তি হল এবং সে তার পছন্দ মত বিষয় নির্বাচন করল। কলেজের প্রাথমিক দায়িত্ব হল তার পছন্দ করা বিষয় অনুযায়ী রুটিনে ক্লাস দেওয়া, এমন ভাবে যাতে সে তার অন্য ক্লাসগুলিও করতে পারে নির্বিঘ্নে। এই কাজটি যে কি মারাত্মক তা ভুক্তভুগীরা ভালোই জানেন। কারন রুটিনে ক্লাস দেবার পাশাপাশি সেই ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট শ্রেণীকক্ষ নির্ধারণ করাও দরকার। কিন্তু জেলার বা রাজ্যের যে কোন বড় কলেজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষের অভাব। ফলে পছন্দ মত বিষয় নিয়ে পড়ার স্বাধীনতা খর্ব হতে বাধ্য। কার্যতঃ দুধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই পাঠক্রম সাফল হতে পারে---যে প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো অসীম অথবা দূরশিক্ষা প্রতিষ্ঠানইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের পাঠক্রম দীর্ঘদিন আগেই চালু হয়েছে এবং তা  সাফল্যের সঙ্গে চলছে। কারন সেখানে পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার প্রশ্ন নাই।

ইউজিসি প্রস্তাবিত এবং রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গৃহীত পাঠক্রমে দুধরণের ডিগ্রী প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে  আন্ডার গ্রাজুয়েট স্তরে, অনার্স অথবা প্রোগ্রাম। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ ও প্রয়োজন মত ডিগ্রী নিতে পারে। তবে পাঠক্রমের মাঝে শিক্ষার্থী যদি মনে করে যে সে অনার্স নয় প্রোগ্রামে যাবে বা উল্টোটা করবে, তার পথ এই পাঠক্রমে খোলা নাই বললেই চলেঅথবা কিছুদিন পড়ার পর তার মনে হল যে ইতিহাস অনার্স তার জন্য নয়, বরং বাংলা বা সংস্কৃত তার পক্ষে উপযুক্ত হবে, সেক্ষেত্রেও তার হাত পা কার্যতঃ বাঁধা। যে কোন শিক্ষার্থীর এমনটা মনে হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেমিস্টার একবার শুরু হয়ে গেলে অনার্স পরিবর্তন করা শক্ত। আগের ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের এই সুযোগ থাকত। কারন তখন সেমিস্টারের তাড়া থাকত না এবং শিক্ষার্থীও নিজেকে সামলে নেবার সুযোগ পেত। অনার্স ও প্রোগ্রামের সিলেবাস আলাদা করার যৌক্তিকতাও বোধগম্য হয়না।

এই পাঠক্রম চালু করার আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সেই পথে না হেঁটে কে কত আগে এই পাঠক্রম চালু করতে পারে সে নিয়ে এক হাস্যকর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল।  সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উৎসাহ ছিল এক্ষেত্রে চোখে পড়ার মত যাদের এই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো বা পারদর্শিতা কোনটাই এখনও গড়ে ওঠেনি যা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিলেবাস তৈরী না করেই অনেক ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সিবিসিএস চালু করে দেয়। সিলেবাস না থাকায় সেমিস্টার শুরু করতেই মাস দুয়েক কেটে যায়। তাড়াতাড়ি করে বিশ্ববিদ্যালয় যে সিলেবাস তৈরী করল তা ত্রুটিপূর্ণ এবং অবাস্তবশিক্ষার্থীদের প্রয়োজন এবং সুবিধা আসুবিধার দিকে তাকিয়ে যে সেই সিলেবাস তৈরী হয়নি তা পরিষ্কারযে বিষয়গুলি কখনও রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হয়নি সেই বিষয়গুলিকে সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করা হয় যার উপযোগী বইপত্র ছাত্র কিম্বা শিক্ষকদের কাছে সহজসভ্য নয়। নতুন সিলেবাস পড়াতে গেলে শিক্ষকদের যে প্রস্তুতির সময় প্রয়োজন ছিল তাও মেলেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তাড়াতে। বেশকিছু বিষয়ে বাংলা ভাষায় কোন বই নাই। অথচ কলেজ স্তরে রাজ্যের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই যে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে এটা সিলেবাস তৈরীতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের না জানার কথা নয়।

পাঠক্রমটি ও তার মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থী মহলে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টাও অভাব আছে। ফলে এনিয়ে শিক্ষার্থী, এমনকি অধ্যাপক মহলেও যথেষ্ট সংশয় আছে শিক্ষার্থীদের  অস্বাভাবিক হারে অকৃতকার্যতা বৃদ্ধির অন্যতম কারন এটাই। এই ব্যবস্থায় কোন একটি কোর্সে যদি শিক্ষার্থী ৪০% র কম নম্বর পায় তাহলে সে কোন গ্রেড পয়েন্ট পাবে না এবং লেটার গ্রেড হিসাবে ‘এফ’ পাবে। সেক্ষেত্রে সেই শিক্ষার্থীকে অকৃতকার্য ধরা হবে। ‘এফ’ পাওয়া সেই কোর্স ‘কোর কোর্স’ হতে পারে বা ‘এবিলিটি এনহান্সমেন্ট কম্পালসারি কোর্স’ (এইসিসি)ও হতে পারে। পরীক্ষায় এই কোর্সগুলিও যে ‘কোর কোর্সের’ মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই সচেতনতা তৈরী করা যায়নি যার প্রভাব পড়েছে তাদের মূল্যায়নে। তাই পাঠক্রমটি চালু করার আগে সর্বস্তরে এনিয়ে সচেতনতা তৈরী করা জরুরী ছিল যা করা হয়নি

এই পাঠক্রমটি সেমিস্টার ভিত্তিক যা পূর্ববর্তী বার্ষিক মূল্যায়ন থেকে আলাদা। কাগজে কলমে ছয় মাস ব্যাপী সেমিস্টারের পর পরীক্ষা। কিন্তু বাস্তবে ঐ সীমিত সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার সময় থাকে না। গোটা ব্যাপারটাই টি-টোয়েন্টি সুলভ তান্ডবলীলায় পরিণত হয়। ছাত্রছাত্রী বা অধ্যাপক কারুর হাতেই সেট হবার সময় নাই। সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজের  মুক্ত পরিবেশে এসে তার সঙ্গে মানিয়ে নেবার কিছুটা সময় কি এদের প্রাপ্য নয়? সেমিস্টার পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত উপস্থিতির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়ে থাকে। ন্যূনতম ৭৫% উপস্থিতি ছাড়া সচরাচর পরীক্ষায় বসার অনুমতি মেলে না। শিক্ষার্থীদের অসন্তোষের এটা একটা বড় কারন যা নিয়ে কলকাতার কয়েকটি কলেজে তো রীতিমত অশান্তি হয়েছে।

সেমিস্টার ভিত্তিক সি বি সি এস পাঠক্রমের তাৎক্ষণিক অসুবিধাগুলির থেকেও গভীরতর সমস্যাটি হল এই ধরণের পঠনপাঠনে শিক্ষার্থী বা শিক্ষক কারুরই হাঁফ ফেলার সময় মেলে না। কোন রকমে সিলেবাস শেষ করাই যেন শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। পাঠক্রমটিকে আত্মস্থ করা বা সেনিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কোন অবকাশ পায় না শিক্ষার্থীরাকলেজ বিশ্ববিদ্যালয় যে কেবলমাত্র তথ্য সরবরাহের জায়গা নয়, শিক্ষার্থীদের ভাবতে শেখার জায়গা তা আমরা ভুলতে বসেছি। শুধুমাত্র তথ্যের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসার প্রয়োজন আজ ফুরিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের যুগে তথ্য আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে সহজলভ্য।

তাই ভারতে উচ্চশিক্ষার মনোন্নয়নের জন্য এই ধরনের আধা-খামচা উদ্যোগে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। ইউজিসি যদি সত্যি করেই উচ্চশিক্ষার মনোন্নয়নের জন্য চিন্তিত হয় তাহলে সর্বাগ্রে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে নজর দিকপাঠক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি এমন ভাবে গড়ে তোলা হোক যাতে শিক্ষার্থীরা পঠনপাঠনকে উপভোগ করতে পারে এবং নতুন কিছু ভাবতে শেখে। তাদের পিছনে সেমিস্টারের পাগলা কুকুর লেলিয়ে দিয়ে আখেরে লাভ কিছু হবে না। কলেজ জীবনে যেমন পড়াশোনা থাকবে, তেমনি রাজনীতি, আড্ডা, বিতর্ক, প্রেমও থাকবে যেগুলি তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়।



ডিভিসি ও বন্যা নিয়ন্ত্রন


কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া বন্যা আমাদের ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যার স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। ’৭৮ সালের পর আরও বেশ কয়েকটি বড় বন্যা দক্ষিণ বঙ্গের এক বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল প্রবল বৃষ্টির পাশাপাশি ডিভিসির জলাধারগুলি থেকে ক্রমাগত জল ছাড়া বন্যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে নিয়ে প্রতিটি বড় বন্যার সময় রাজ্য সরকার ও ডিভিসি কর্ত্তৃপক্ষের মধ্যে চাপান উৎরান সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের কল্যানে আমাদের সকলের জানা বিগত বন্যার সময়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবেই বন্যা নিয়ন্ত্রনে ডিভিসির ভূমিকা নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন চিহ্ন তৈরী হয়েছে জনমনে। এই লেখার উৎস সেখান থেকেই।

দামোদর নদের বন্যা কোন নতুন ব্যাপার নয়। দামোদর উপত্যকার মানুষ এই ‘দুঃখের নদী’র সঙ্গে ঘর করেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই। নদীর বন্যা যেমন মাঝে মধ্যে তাদের সর্বস্ব গ্রাস করত তেমনি ফসলে, সম্পদে ভরিয়ে দিতেও কার্পণ্য করত না। সে কারনেই মানুষ যুগ যুগ ধরে নদীকে পূজো করে। একই সঙ্গে মানুষ নদীকে নিয়ন্ত্রণ ও করেছে সাধ্যমত। তবে নদীকে নিয়ন্ত্রন করা আর তাকে দমন করার মধ্যে পার্থক্য আছে। মহাকাব্যে ও পুরাণে ভগীরথের উপাখ্যান বোধহয় সেই ইঙ্গিতই করে।
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বৃটিস প্রযুক্তিবিদরা দামোদরের বন্যা নিয়ন্ত্রণে উচ্চ অববাহিকায় জলাধার নির্মানের সুপারিশ করেছিলেন। তবে বিভিন্ন কারনে এই পরিকল্পনা রূপায়িত হয়নি। কিন্তু  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংকটময় কালে ১৯৪৩ এর বন্যা বৃটিশ সরকারকে বাধ্য করে এনিয়ে নতুন করে ভাবনা চিন্তা করতে। এরই ফলশ্রুতিস্বরূপ দামোদরের বন্যা নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার Tennessee Valley Authority (TVA) র মডেল অনুসরণ করে দামোদর উপত্যকার সার্বিক উন্নয়নের একটি খসড়া প্রকল্প তৈরী করা হয় যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দামোদরের বন্যা নিয়ন্ত্রন। এই খসড়া প্রকল্পটি তৈরী করেন TVA  এর একজন বরিষ্ঠ প্রযুক্তিবিদ, W. L. Voorduin তিনি দামোদরের উচ্চ অববাহিকায় সাতটি জলাধার নির্মানের কথা বলেন যার মাধ্যমে নিম্ন দামোদর অববাহিকায় আসা দামোদরের জলকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং একই সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলসেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এছাড়াও ভূমিক্ষয় রোধ, জলপথ পরিবহন, পানীয় ও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করা যাবে জলাধারগুলি থেকে। ১৯৪৮ সালের ২৭শে মার্চ “দামোদর ভ্যালী কর্পোরেশন আইন, ১৯৪৮” বিধিবদ্ধ হয়।

এই আইনের ১২ নং ধারায় বলা হয় যে ডিভিসি নিম্নলিখিত ছয়টি কাজে উদ্যোগী হবে। সেগুলি হল
·        জলসেচ ও জল সরবরাহ
·        বিদ্যুৎ (জলবিদ্যুৎ ও তাপ বিদ্যুৎ) উৎপাদন ও বন্টন
·        দামোদর ও তার শাখানদীগুলির বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও হুগলি নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি
·        দামোদর ও তার শাখানদীগুলিতে নৌপরিবহন
·        বৃক্ষরোপণ ও ভূমিক্ষয় রোধ
·        জনস্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প এবং সামগ্রিকভাবে দামোদর অববাহিকার উন্নয়ন।

লক্ষ্যনীয় এই যে বন্যা নিয়ন্ত্রন  অগ্রাধিকারের নিরীক্ষে তৃতীয় স্থান পায়। আইনের ১৩ থেকে ২০ নং ধারায় জলসেচ, জল সরবরাহ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি কথাও সেখানে উল্লেখ নাই।

দামোদর উপত্যকায় বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পটি রূপায়নেও বেশ কিছু বিচ্যুতি ঘটে। প্রকল্পে  প্রস্তাবিত সাতটি জলাধারের পরিবর্তে চারটি মাত্র জলাধার নির্মান করা হয় তিলাইয়া, মাইথন, পাঞ্চেত এবং কোনারে যাদের সম্মিলিত জলধারণ ক্ষমতা প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাত্র ৫৫%পরবর্তী কালে বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) সরকার তেনুঘাটে আর একটি জলাধার নির্মান করে ১৯৭৪ সালে যা ডিভিসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু ডিভিসি  আর নতুন কোন জলাধার নির্মান করতে পারেনি। ইতিমধ্যে পুরোন জলাধারগুলির জলধারণ ক্ষমতা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে পঞ্চাশ বছর পার করে। ফলে কার্যকর বন্যা নিয়ন্ত্রণ যে ডিভিসির পক্ষে আর সম্ভব নয় তা পরিষ্কার। শুধু তাই নয় বন্যা নিয়ন্ত্রনে ডিভিসি কতটা বদ্ধপরিকর সে নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

এনিয়ে সন্দেহ নাই যে ডিভিসি একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প এবং ডিভিসি তার বন্যা নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্য থেকে বহু যোজন দূরে সরে গেছে। ডিভিসির বিগত কয়েক বছরের বাৎসরিক প্রতিবেদনগুলির উপর নজর দিলেই এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টনই হল এখন ডিভিসির মুখ্য উদ্দেশ্যপশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির বিদ্যুতের চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ করে ডিভিসি। ডিভিসি প্রকল্প পুরোপুরি রূপায়িত হলে কী হত তা কল্পনা সাপেক্ষ। তবে প্রকল্পটির মধ্যেও কিছু স্ববিরোধিতা ছিল সে নিয়ে সন্দেহ নাই। বন্যা নিয়ন্ত্রন ও জলসেচ একে অপরের পরিপূরক হলেও একই সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রন ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন পরস্পর বিরোধী ধারণা। জলাধারগুলিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের অনুকূল করতে হলে বর্ষার আগে সেগুলি খালি রাখা জরুরী যাতে বর্ষার জল ধরে রাখা যায়কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে জলাধার খালি রাখা সম্ভব নয়। এছাড়াও রবি মরসুমে চাষের জল সরবরাহের জন্যও জলাধারে জল ধরে রাখা হয়। তাই অতিবর্ষণের সময় বাড়তি জল ধরে রাখা সম্ভব হয় না জলাধারগুলির পক্ষে। ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যত শিকেয় ওঠে শুধু তাই নয় বন্যা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে জলাধার থেকে বাড়তি জল ছাড়ার ফলে। এই পরিস্থিতিতে ডিভিসি যে ভূমিকাটি পালন করে তা বন্যা নিয়ন্ত্রকের নয়, বন্যা ব্যবস্থাপকের। বহুমুখী নদী প্রকল্পের যেমন সুবিধা আছে তেমনি আর অসুবিধেগুলিও যে কম নয়, ডিভিসি তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

একটি বিষয় ডিভিসি কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখতে পারেন, তা হল’ ডিভিসির জলাধারগুলিকে কেবলমাত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হোক, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নয়। ডিভিসির মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের কমবেশী মাত্র দুই শতাংশ (১৫০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি) আসে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি থেকে যে ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে আর একটি নতুন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরী করে। একমাত্র  অনাবৃষ্টির বছর সেচের জলে ঘাটতি দেখা দিতে পারেতা না হলে প্রায় সারা বছর দামোদর ও ডিভিসির ক্যানেলগুলিতে জলের সরবরাহ অব্যাহত থাকবে আশা করা যায়। বন্যাজনিত প্রাণ ও সম্পদহানির হিসাব মাথায় রাখলে ১৫০-২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরীর খরচ খুব বেশী হবে বলে মনে হয়না। বাড়তি পাওনা হবে বর্ষা ছাড়া বছরের অন্য সময় দামোদরের মরা খাতে জলের দেখা মেলা যার পরিবেশগত মূল্য অসীমদামোদর ও তার শাখা নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আমরা নদীগুলিকে কার্যত মেরে ফেলতে চলেছি যা কোন অজুহাতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলনে সামিল হন বর্ধমানের রাজসভাপণ্ডিত মধুসূদন তর্কপঞ্চানন


নদীয়া জেলার বাহিরগাছি গ্রামে মধুসূদন ভট্টাচার্যের জন্ম। সংস্কৃতচর্চায় বাহিরগাছির  ভট্টাচার্য পরিবারের বিশেষ সুনাম ছিল। মধুসূদন ভট্টাচার্যের পিতামহ ছিলেন রঘুমণি বিদ্যালঙ্কার যিনি হেনরী কোলব্রুকের অনুরোধে “শব্দমুক্তামহার্ণব” (১৮০৭) নামে একটি অভিধান সংকলন করেন তাঁর পিতা শ্রীকান্ত তর্কালঙ্কারও ছিলেন প্রথিতযশা পণ্ডিত। মধুসূদনের শিক্ষারম্ভ তাঁর পিতার কাছেইপরে বেনারসে উচ্চ শিক্ষা লাভ। সেখান থেকেই সম্ভবত তিনি ‘তর্কপঞ্চানন’ উপাধি লাভ করেন। বেনারস থেকে ফিরে তিনি গ্রামে নিজের চতুষ্পাঠী খোলেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা অনেকেই  রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। বর্ধমানের মহারাজা মহতাব চাঁদের আহ্বানে মধুসূদন বর্ধমান রাজসভার পণ্ডিত হিসাবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক মহতাব চাঁদের কীর্তিকাহিনী বর্ণনা করে “মহারাজাধিরাজ চরিতম্‌” (১৮৭৬) রচনা করেন। আদ্যান্ত ঐতিহ্যগত শিক্ষায় শিক্ষিত এই মধুসূদন তর্কপঞ্চাননের সঙ্গে  কালক্রমে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এক গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মধুসূদন বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে সামিল হন।

সেই সময়ের এই দুই দিকপাল পণ্ডিতের সম্পর্কের রসায়নটি ছিল বেশ অদ্ভুত। দুজনের সামাজিক অবস্থান, শিক্ষাদীক্ষা ও ভাবনাচিন্তার মধ্যে বৈপরীত্য ছিল চোখে পড়ার মত। একজন ঐতিহ্যগত শিক্ষায় শিক্ষিত মফস্বলের রাজসভাপণ্ডিত অন্যজন নগরকেন্দ্রিক কলেজ শিক্ষিত সংস্কারপন্থী পণ্ডিত। বিদ্যাসাগর এমন এক সংস্কৃত শিক্ষার কথা ভাবতেন যা পাশ্চাত্য জ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে চলবে। পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষা শিক্ষার উন্নয়নেও বদ্ধপরিকর ছিলেন। অন্য দিকে মধুসূদনের সমগ্র জগত জুড়ে ছিল সংস্কৃত। তিনি বাংলা ভাষায় লিখতে পছন্দ করতেন না। তাঁর সমস্ত লেখাপত্রই সংস্কৃত ভাষায় লেখা। মহতাব চাঁদের উদ্যোগে বর্ধমান থেকে যে দুই খন্ডের “প্রশ্নোত্তরমালা” গ্রন্থ প্রকাশিত হয় (১৮৭৩/৭৯) সেখানে অন্যান্য পণ্ডিতরা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর বাংলায় দিলেও মধুসূদন কেবলমাত্র সংস্কৃত ভাষাতেই উত্তর দেন। মধুসূদন ছিলেন সেই বিরল গোষ্ঠির পণ্ডিতদের একজন যাঁরা সংস্কৃত ভাষাকে একান্তভাবে আঁকড়ে ছিলেন যখন ইংরাজী এবং বাংলা শিক্ষা বাংলাদেশে শিক্ষার ধরণটিকে অমূল বদলে দিচ্ছিল। সুকুমার সেনের মতে এক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে মিল ছিল বর্ধমানের আর এক দিকপাল পণ্ডিতের। তিনি ছি্লেন সংস্কৃত কলেজের অলঙ্কারের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। মধুসূদন তাঁর সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ “বামনাখ্যানম্‌” (১৮৭৩) এর প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেন যে তাঁর বন্ধুরা অনেকে এর বঙ্গানুবাদ করতে তাঁকে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু বাংলায় লেখা তাঁর অভ্যাস নাই। তাই তিনি তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেন ওই কাজটি করার জন্যবিদ্যাসাগরও সেই বন্ধুকৃত্য করতে পিছপা হননি যা তাঁদের গভীর বন্ধুত্বের সাক্ষ্য বহন করে। মধুসূদন যেমন বিদ্যাসাগরের কলকাতার বাড়িতে যেতেন তেমনি বিদ্যাসাগরও মাঝে মধ্যে কলকাতার নাগরিক জীবনের চাপ কাটাতে বাহিরগাছায় চলে যেতেন। শোনা যায় একবার মধুসূদনের  আকস্মিক অসুস্থতার কারনে তাঁদের বাহিরগাছার বাড়িতে অষ্টমীর পুজো সম্পন্ন করেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত চর্চার প্রতি একাগ্র আনুরাগ সত্ত্বেও মধুসূদন তর্কপঞ্চানন বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হন।

আপাতদৃষ্টিতে এই দুই পণ্ডিতের বন্ধুত্ব কিছুটা বেমানান লাগলেও বিষয়টা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। কলকাতা ও কলকাতা কেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চার সঙ্গে বাহিরগাছার ভট্টাচার্য পরিবারের যোগাযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। মধুসূদনের পিতামহ রঘুমণি বিদ্যালঙ্কারের উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোডে একটি চতুষ্পাঠী ছিল। প্রখ্যাত প্রাচ্যতত্ববিদ হেনরী কোলব্রুকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পারিবারিক উদার পরিমণ্ডল ছাড়াও মধুসূদনের সঙ্গে কলকাতার তৎকালীন সামাজসংস্কার আন্দোলনের যোগাযোগ গড়ে ওঠার পিছনে অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন খুব সম্ভবত তাঁর পৃষ্ঠপোষক মহতাব চাঁদ। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মহতাব চাঁদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মহতাব চাঁদ ছিলেন বিদ্যাসাগরের সংস্কার প্রচেষ্টার সমর্থক এবং সেই কারণে বিদ্যাসাগর প্রায়শঃই বর্ধমানে আসতেন তাঁর সাহায্য নিতে। মধুসূদন তাঁর পৃষ্ঠপোষকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে থাকতে পারেন।

মধুসূদন তর্কপঞ্চানন বিধবা বিবাহের সমর্থক ছিলেন। ১৮৫৩ সালে কলকাতায় শ্যামাচরণ দাস সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের আহ্বান জানান বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত কিনা সে নিয়ে তাঁদের মতামত জানাতে। মধুসূদন বিধবা বিবাহের পক্ষে স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলনে এবং বিধবা বিবাহ সম্পাদনে তাকে সহযোগীর ভূমিকায় দেখা যায়। তবে সব ক্ষেত্রে যে তিনি বিদ্যাসাগরের মত মেনে নিয়েছিলেন এমনটা নয়বহু বিবাহ প্রথা নিয়ে বিদ্যাসাগরের  অবস্থান তিনি সমর্থন করেননিসেক্ষেত্রে বর্ধমানের আর এক প্রথিতযশা পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচষ্পতির সঙ্গে তাঁর অবস্থান কিছুটা মিলে যায়। অম্বিকা কালনার তারানাথ তর্কবাচষ্পতি বিদ্যাসাগরের থেকে বয়সে কিছুটা বড় হলেও তিনি ছিলেন সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সহপাঠী এবং পরবর্তী কালে তাঁর সহকর্মী ছিলেন স্ত্রী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলনে তারানাথ বিদ্যাসাগরের পক্ষে এসে দাঁড়ালেও বহু বিবাহ বিরোধী আন্দোলনে তিনি বিদ্যাসাগরের তীব্র সমালোচক ছিলেন। তবে পার্থক্য হল এই যে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তারানাথের ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি পরবর্তীকালে যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় মধুসূদনের সঙ্গে তেমনটা ঘটেনি। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে সেই যুগের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরা আর যাই হোন সকলেই একই ছাঁচে ঢালা ছিলেন না। পরিবর্তনপন্থী বা পরিবর্তনবিরোধী এমন সরল সমীকরণের সাহায্যে ও তাঁদের বোঝা যাবে না। তাঁরা কোন কাল্পনিক জগতের বাসিন্দাও ছিলেন না, ছিলেন বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষ। সমসাময়িক সামাজিক বিতর্কে তাঁদের অবস্থান নির্ধারণে বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ঈর্ষা, আত্মগরিমা এসবের ভূমিকাও কম ছিল না।

বিজয় চতুষ্পাঠীকে বাঁচানো প্রয়োজন


পশ্চিমী প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা কিছু স্বতঃসিদ্ধ ধারনার বশবর্তী হয়ে প্রাচ্যের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল ঔপবিবেশিক শিক্ষা নীতি নির্ধারণে। ইংরাজী ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন ভারতের ঐতিহ্যগত দেশীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে পঙ্গু করে দেয়। নগরে, গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মক্তব-মাদ্রাশা-টোল-চতুষ্পাঠীগুলি নতুন জামানায় দ্রুত সেকেলে হয়ে পড়ে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকরাও হাত গুটিয়ে নেন যার ফলে সেগুলি কার্যতঃ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। অবশ্য এর ব্যতিক্রম যে একেবারেই ছিল না তেমনটা নয়। এই রকম একটি ব্যতিক্রমী সংস্কৃত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল বর্ধমানের ‘বিজয় চতুষ্পাঠী’


নবদ্বীপ বিদ্বৎসমাজের গৌরব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে রাঢ়, বিশেষ করে দক্ষিণ রাঢ়ই ছিল বাংলার প্রধান সারস্বত কেন্দ্র। বর্ধমান রাজবংশের বিদ্যোৎসাহিতার ফলে বর্ধমানকে কেন্দ্র করে অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকেই বহু টোল ও চতুষ্পাঠী স্থাপিত হয়েছিলউইলিয়াম অ্যাডামের প্রতিবেদনে বাংলায় ১৮০০ টি সংস্কৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ মেলে যার মধ্যে বর্ধমান জেলায় ছিল ১৯০টি এদের অধিকাংশই ছিল কালনা, আউসগ্রাম, বালকৃষ্ণ, পূর্বস্থলী, রায়না, কাটোয়া, পোতনা ও মঙ্গলকোট থানায়। সেসময় বর্ধমানের প্রথমসারির সংস্কৃত পণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন কালিদাস সার্বভৌম, গুরুচরণ পঞ্চানন, ঈশ্বরচন্দ্র ন্যায়রত্ন, কৃষ্ণমোহন বিদ্যাভূষণ, রঘুনন্দন গোস্বামী এবং সর্বোপরি প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ যিনি ছিলেন সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের অন্যতম শিক্ষাগুরু

তবে ইংরাজী শিক্ষার দ্রুত বিকাশের সঙ্গে তাল মেলাতে সংস্কৃত শিক্ষা ব্যর্থ হয়। ১৮২৪ সালে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর  সংস্কৃত শিক্ষার একটি অভিন্ন মানদণ্ড গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয়। তবে ঐতিহ্যগত টোল-চতুষ্পাঠী কেন্দ্রিক সংস্কৃত শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃত কলেজ অনুসারী আধুনিক সংস্কৃত শিক্ষার দ্বন্দ্ব থেকেই যায়। ১৮৯১ সালে বৃটিস সরকার তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নকে দায়িত্ব দেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার টোলগুলির উপর একটি সমীক্ষা করতে। মহেশচন্দ্র তাঁর প্রতিবেদনে বর্ধমান জেলার কয়েকটি উৎকৃষ্ট টোলের উল্লেখ করেন যার মধ্যে  অন্যতম ছিল পূর্বস্থলীর কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন পরিচালিত টোলটি এবং বর্ধমানরাজ তেজচাঁদ প্রতিষ্ঠিত টোলটি।  আয়ুর্বেদ চর্চায় এই জেলার মানকরের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। তবে এবিষয়ে সন্দেহ নাই যে উনিশ শতকের শেষ দিকেই সংস্কৃত চর্চা প্রান্তিক হয়ে পড়ে। কালের চাহিদা অনুযায়ী অনুযায়ী ছাত্রদের অধিকাংশই ইংরাজী শিক্ষায়তনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এমনকি সংস্কৃত পণ্ডিতদের পরিবারের সন্তানরাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের পুত্ররা সকলেই ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত হন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর “যুগান্তর’’ উপন্যাসে এই বিষয়টিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন যেখানে তর্কভূষণ মহাশয় তার বড় ছেলেকে টোলে পাঠাচ্ছেন আর বাকীদের পাঠাচ্ছেন ইংরাজী শিক্ষায়তনের। শিবনাথ শাস্ত্রী নিজেও ছিলেন একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের সন্তান যদিও তাঁর পিতার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ডেভিড হেয়ারের স্কুলে ভর্তি করে ভাল ইংরাজী শেখাবেন। কারন তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে বুছেছিলেন যে ‘ইংরাজীর গন্ধ না হইলে কাজ কর্ম পাইবার সুবিধা নাই’। তবে হেয়ার স্কুলে ভর্তি না হয়ে তিনি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন যেখানে ইংরাজী শিক্ষাও চালু হয়।


এই পরিস্থিতিতে সংস্কৃত চর্চাকে উৎসাহ দিতে বিজয়চাঁদ মহতাব বর্ধমান রাজপরিবার প্রতিষ্ঠিত চতুষ্পাঠীটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৯ সালে (১৩০৬ বঙ্গাব্দে)। তাঁর নামানুসারে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় ‘বিজয় চতুষ্পাঠী’। বর্ধমান শহরে রাজ স্কুলের পিছনে ভগ্নপ্রায় অবস্থায় এই প্রতিষ্ঠানটি আজও বিদ্যমান। চতুষ্পাঠীটির তিনটি স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল-ন্যায়, স্মৃতি ও বেদান্ত। হরিনাথ বেদান্ততীর্থ (১৮৯৯-১৯২৪), রমেশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ (১৯১৪-১৯৩২), মহামহোপাধ্যায় বীরেশ্বর তর্কতীর্থ (১৯১৪-১৯৩২), নৃসিংহ স্মৃতিভূষণ (১৯২৪-১৯৫২), হরেন্দ্রনাথ বেদান্ততীর্থ (১৯৩৩-১৯৫৪), রামহরি স্মৃতিতীর্থ (১৯৪১-১৯৪৫) প্রমূখ অধ্যাপকরা এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করেছেন। ‘বিজয় চতুষ্পাঠী’তে বেদান্তদর্শন পড়াবার ব্যবস্থা করায় ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা তার তীব্র সমালোচনা করে এই বলে যে, বিজয়চাঁদের মতো একজন  আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাবধারা পুষ্ট মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগের জীর্ণ ও অচল ভারধারা পুনঃপ্রবর্তন করতে চলেছেন।‘বিজয় চতুষ্পাঠী’ ছিল আবাসিক প্রতিষ্ঠান। এর যাবতীয় খরচ বর্ধমান রাজপরিবার বহন করতছাত্র-অধ্যাপকদের শুধু পড়াশুনা ও খাওয়া-দাওয়ার খরচ নয়, প্রায়ই তাঁদের নিমন্ত্রন আসত রাজবাড়ি কিম্বা লক্ষ্মীনারায়ণ জীউ এর মন্দিরে যেখান থেকে তাঁদের পোষাক-আশাক ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দান করা হত। চতুষ্পাঠীটির নিজস্ব গ্রন্থাগারটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ।

বর্তমানে আশি জন ছাত্র, তিন জন অধ্যাপক ও একজন অশিক্ষক কর্মচারী নিয়ে ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানটি ধুঁকছে লোকচক্ষুর আড়ালেস্কুল শিক্ষা দপ্তর থেকে নিয়মিত বেতন মিললেও প্রতিষ্ঠানটি আজ মৃতপ্রায়। বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পর্ষদ আয়োজিত পরীক্ষা দীর্ঘ দিন বন্ধ। ফলে ছাত্রদের ভবিষ্যত অন্ধকারে। এখনকার ছাত্রদের অধিকাংশই পৌরহিত্য পেশার জন্যই এখানে পড়তে আসে।  অন্য চাকুরীর দরজা এদের কাছে কার্যত বন্ধ। চতুষ্পাঠী ভবনটিও দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। ছাদ থেকে জল পড়ে গ্রন্থাগারের রক্ষিত বই ও পুঁথিগুলি নষ্ট হতে বসেছে।  একই অবস্থা রাজ্যের অন্যান্য সংস্কৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিরও।

বর্ধমানের এই ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানটি এবং সেখানে রক্ষিত বই ও পুঁথিগুলির সংরক্ষণে  অবিলম্বে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি রাজ্য সরকার সংস্কৃত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেছে যা রাজ্যে সংস্কৃত চর্চাকে উৎসাহিত করবে সন্দেহ নাই। টোল-চতুষ্পাঠীগুলিকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সমান্তরাল ধারা হিসাবে না ভেবে ঐতিহ্যগত শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবেও ভাবা যেতে পারে। তাহলে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কালের কবল এড়িয়ে বেঁচে যেতে পারে। তবে ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের দিকটিও মাথায় রাখতে হবে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারও সম্প্রতি সংস্কৃত শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন রকম প্রকল্প নিয়েছেন যার সুযোগ নেওয়া যেতে পারে আমাদের এই ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে।

বর্ধমান জেলা মহাফেজখানা


বর্ধমান শহরের কোর্ট চত্ত্বরে অবস্থিত ‘জেলা মহাফেজখানাটি’ বহু মূল্যবান নথিপত্রের এক অমূল্য ভান্ডার। জেলার মহাফেজখানাগুলি সচরাচর এরাজ্যের গবেষকরা বিশেষ ব্যবহার করেননা। তাঁদের নজরে থাকে মূলতঃ কলকাতায় অবস্থিত স্টেট আর্কাইভস্‌ কিম্বা দিল্লির নাশানাল আর্কাইভস্‌তবে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় জেলা স্তরের সরকারী মহাফেজখানাগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। নব্বই এর দশকের শুরু থেকেই বর্ধমানের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। শুরুটা হয় অপেশাদার নাগরিক ঐতিহাসিকদের হাত ধরেই। তবে পরে ইতিহাসের ছাত্র গবেষকরাও বর্ধমানের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় মনোনিবেশ করেন এর সূত্র ধরেই  নব্বই এর শেষের দিকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের পক্ষ থেকে জেলা মহাফেজখানার নথিপত্রের একটি তালিকা প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে তা বেশীদূর এগোয়নি। সম্প্রতি এই ধরণের আর একটি উদ্যোগ নেওয়া হয় যাতে আমার সঙ্গী হন আমার এক তরুণ গবেষণা সহায়ক, শ্রী অয়ন কুণ্ডু এবং বর্ধমানের এক বিশিষ্ট গবেষক ড. সর্বজিৎ যশ

জেলা মহাফেজখানার সবচেয়ে পুরোন নথিগুলির মধ্যে অন্যতম হল ১৭৮৮ সাল থেকে বর্ধমান কালেক্টরেট থেকে প্রেরিত ও কালেক্টরেটে আগত সরকারী চিঠিপত্রের সংগ্রহ। ১৯৫৫-৫৬ সালে অশোক মিত্রের সম্পাদনায় এই চিঠিগুলির একাংশের অনুলিপি দু’খণ্ডে মুদ্রিত হয় West Bengal District Records (New Series): Burdwan: Letters Received, 1788-1802 (1955) এবং  West Bengal District Records (New Series): Burdwan: Letters Issued, 1788-1800 (1956)  নামে। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ছিল একটি সাধু উদ্যোগ। তবে পরবর্তীকালে ঐ চিঠিগুলির দীর্ধমেয়াদী সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ইতিমধ্যেই কালের গ্রাসে বেশকিছু চিঠি নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলি আছে সেগুলির অবিলম্বে সংরক্ষণ প্রয়োজন। ১৭৮৮ থেকে ১৮৬৫ সময়পর্বে এই ধরণের হাতে লেখা চিঠির ১৩৭৮ টি বাঁধানো খণ্ড পাওয়া গেছে (আনুমানিক ১৯৫৬৮ পৃষ্ঠা)। চিঠিপত্রের পাশাপাশি জেলা মহাফেজখানায় রক্ষিত আছে হাজারের উপর হাতে আঁকা ( কাগজে আঁকা ও কাপড়ের উপর সাঁটানো) মৌজা ও পরগনার মানচিত্র যা ‘থাক বস্ত ম্যাপ’ নামে চিহ্নিত যার সবগুলিই ১৮৫৫ সালের। এছাড়া রয়েছে রাজস্ব সংগ্রহ সংক্রান্ত আজস্র ফাইল, পুলিস রেকর্ড, রেল ও কয়লাখনি সংক্রান্ত  অসংখ্য দলিল। ইতিহাসের ছাত্র, গবেষকরা এই মহাফেজখানাটি গবেষণার স্বার্থে ব্যবহার করলে বিশেষ উপকৃত হবেন বলেই আমার ধারণা।

মহাফেজখানাটির রক্ষণাবেক্ষণে জেলা প্রশাসনকে একটু যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। মহাফেজখানা বাড়িটি সংরক্ষিত নথিপত্রের তুলনায় ছোট এবং পরিকাঠামোও পুরোন নথিপত্র রাখার উপযুক্ত নয়। জেলা প্রশাসনের উচিত এব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক নথিগুলি ডিজিটাইজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সেই উদ্যোগেও যথেষ্ট খামতি রয়েছে। পুরোন নথিগুলিকে নষ্ট না করে ডিজিটাইজ করার পদ্ধতি এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হচ্ছে না যা সহজেই করা যায় ওভারহেড স্ক্যানার বা ডি. এস. এল. আর ক্যামেরার সাহায্যে।

এছাড়াও বর্ধমান জেলা ভাগের সাম্প্রতিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এই মহাফেজখানাটি উপরও অবশ্যম্ভাবীরূপে এসে পড়বে। ইতিমধ্যেই মহাফেজখানার কর্মীদের মধ্যে নথিপত্র ভাগের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। এই ভাগাভাগীর চক্করে শতাব্দী প্রাচীন ভঙ্গুর নথিপত্রগুলির যে কি অবস্থা হবে তা ভেবে শঙ্কিত হচ্ছি। জেলা প্রশাসনের উচিৎ অবিলম্বে মহাফেজখানার নথিপত্রগুলি আর্কাইভের মানদন্ড অনুযায়ী সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের স্বার্থে সেগুলি ডিজিটাইজ করে একটি ডিজিটাল আর্কাইভ গড়ে তোলা। আর মহাফেজখানার পুরোন নথিপত্রের একটি স্যারোগেট কপি তুলে দেওয়া পশ্চিম বর্ধমানের নতুন জেলা প্রশাসনের হাতে যাতে তারাও প্রয়োজনে সেই নথিপত্রগুলি ব্যবহার করতে পারে আসল নথিপত্রগুলি নাড়াচাড়া না করেই সেই সঙ্গে নতুন গড়ে তোলা ডিজিটাল আর্কাইভটি উন্মুক্ত করা হোক গবেষকদের কাছে যা জেলার ইতিহাস চর্চাকে সমৃদ্ধ করবে

ইস্কোর বর্জ্য দিয়ে তৈরী হল শিল্পাঞ্চলের সবচেয়ে মনোরম পার্ক



সময়টা ষাটের দশকের শুরু। আসানসোল শিল্পাঞ্চল তখন খ্যাতির মধ্যগগণে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পর্বে ভারী শিল্পের বিকাশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ছাপ তখন এই অঞ্চলের সর্বত্র বিরাজমান। দুর্গাপুর থেকে চিত্তরঞ্জন পর্যন্ত বিস্তৃত শিল্পাঞ্চলে যে কর্মযোগ্য শুরু হয় তা পরিচালিত হতে থাকে আসানসোল থেকে। এই সময়ই আসানসোলের মহকুমা শাসক হয়ে কাজে যোগ দেন এক তরুণ দক্ষিণী প্রশাসক, কে. সি. শিবরামকৃষ্ণান (১৯৩৫-২০১৫)। ১৯৫৮ ব্যাচের এই আই.এ.এস অফিসার  পরবর্তীকালে নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নগর চর্চা বিশারদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সি.এম.ডি.এ এর প্রথম মুখ্যসচিব সহ রাজ্য ও কেন্দ্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি কাজ করেছেন। নগরায়ন নিয়ে তাঁর লেখা ও সম্পাদনা করা বইগুলি নগর প্রসাশক ও নগরায়ন নিয়ে চর্চা করা ছাত্র ও গবেষকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। শিবরামকৃষ্ণানের প্রশাসকজীবন বা তাঁর নগর ও নগরায়ন চর্চার মূল্যায়ন কারা আমার পক্ষে নিতান্তই অনধিকার চর্চা হবে এবং এই লেখার উদ্দেশ্যও তা নয়। গুরুগম্ভীর লেখাপত্রের বাইরে তিনি একটি অসাধারণ স্মৃতিচারণা আমাদের উপহার দিয়েছেন যার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে তৎকালীন আসানসোল-বার্ণপুরের সমাজজীবনের এক মজাদার কোলাজ।

The Enduring Babu: Memoirs of a Civil Servant বইটি হঠাৎ করেই একদিন নজরে আসে। সিভিল সার্ভেন্টদের লেখা স্মৃতিচারণ সচরাচর তাঁদের কর্মজীবনের মতই গুরুগম্ভীর ও অনুশাসনে মোড়া হয়ে থাকে। অন্নদাশংকর রায়ের বিনুর ডায়েরী, যুক্তবঙ্গের স্মৃতি, মুক্তবঙ্গের স্মৃতি  কিম্বা  অশোক মিত্রের তিন কুডি দশ সেই সময়ের মুল্যবান দলিল হিসাবে স্বীকৃত। শিবরামকৃষ্ণানের স্মৃতিচারণা একেবারে অন্য ঘরাণার লেখা। সিভিল সার্ভেন্টসুলভ গাম্ভীর্যের খোলশ ছেড়ে তিনি এমন কিছু মজাদার ঘটনা তুলে এনেছেন তাঁর স্মৃতির মণিকোঠা থেকে যা সেই সময়কে নতুন করে চিনতে আমাদের সাহায্য করে

১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানায় দেশের প্রথম ইলেকট্রিক রেল ইঞ্জিন, ‘লোকমান্য’র উদ্বোধন করতে আসেন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, সঙ্গে বোন বিজয়লক্ষ্মী। সেই উপলক্ষ্য উপস্থিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধান চন্দ্র রায়ও। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে নির্ধিধায় ‘জহরলাল’ সম্বোধন করতে অভ্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের শিল্প মনচিত্রে আবার সামনের সারিতে ফিরিয়ে আনতে তিনি বদ্ধপরিকর। সেকারনে কয়লা নিয়ে কেন্দ্রের মাসুল সমীকরণ নীতির তিনি তীব্র সমালোচক। প্রধানমন্ত্রীকে সামনে পেয়ে তিনি উচ্চকণ্ঠে তাঁর আপত্তির কথা জানান। “জহরলাল, তোমরা যদি এই নীতি  নিয়ে চল তাহলে রাজ্যগুলো কিন্তু বিদ্রোহ করবে”। জহরলাল তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। “ ডাক্তার সাব্‌, ডাক্তার সাব্‌, দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন”। সন্ধ্যায় উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর বিধান চন্দ্র রায় দুর্গাপুর রওনা হবেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে অনুরোধ করেন রাতের খাবার খেয়ে যেতে। কিন্তু তিনি রাজী নন। বিজয়লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমার ভাই এখানে ছুটিতে এসেছে, কিন্তু আমার কাজ আছে। চিত্তরঞ্জনে বাকী সময়টা উপভোগ কর”। এই বলে তিনি গাড়িতে উঠলেন।

সেই রাত্রেই শিবরামকৃষ্ণান বিধান চন্দ্র রায়ের আর এক রূপ দেখলেন। দুর্গাপুরের সরকারী অতিথিশালায় পৌঁছেই মুখ্যমন্ত্রী কাজে ডুবে যান। বেশ কয়েকজন শিল্পপতি আগে থেকেই লাউঞ্জে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শিবরামকৃষ্ণান তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে যান। ঘন্টাখানেক পরই তাঁর ডাক পরে। তাড়াতাড়ি লাউঞ্জে ফিরে দেখেন আলোচনা তখনও চলছে। তাঁকে দেখেই মুখ্যমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন খাওয়া হয়েছে কিনা। হয়নি শুনেই অতিথিশালার রাধুনি পিতাম্বরকে নির্দেশ দেন তাড়াতাড়ি মাছের ঝোল ও ভাত এনে দিতে। পিতাম্বর চলে যেতে শিবরামকৃষ্ণান একটু সাহস সঞ্চয় করে বলেন,
    “কিন্তু স্যার, আমি তো নিরামিষাশী...”
       “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি তোমরা দক্ষিণ ভারতীয়রা সব নিরামিষাশী”
       “কিন্তু স্যার, আমি তো মাছ খাই না...”
       “কেন? মাছ খাও না কেন? কি হয়েছে তোমার? তাহলে খাবে কি?
এমনটাই ছিলেন সেসময় দেশের অন্যতম প্রভাবশালী মুখ্যমন্ত্রী, ড. বিধান চন্দ্র রায়। দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নীতির প্রশ্নে তিনি যতটাই কঠোর হন না কেন একজন নবীন দক্ষিনী সিভিস সার্ভেণ্টের প্রতি ততটাই যত্নশীল অভিভাবকের মত।  

শিবরামকৃষ্ণানের স্মৃতিচারণা থেকে আর একটি অন্য ধরণের গল্প বলে এই লেখা শেষ করব। সেসময় বার্ণপুর ছিল যথার্থ অর্থেই একটি পরিকল্পিত ইস্পাতনগরী। একদিকে কারখানা, অন্য দিকে সারি সারি কোয়ার্টার ও প্রশস্ত বাংলো। সেসময় বার্ণপুরের অন্যতম আকর্ষণ ছিল তার ক্লাবটি যা আসানসোল ক্লাবের মত সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। ক্লাবে প্রবেশাধিকার ছিল কেবলমাত্র ইস্পাত কারখানা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারখানার কর্মচারী ও আমন্ত্রিত সদস্যদের। স্যার বীরেন মুখার্জীর নেতৃত্বে ইস্কো কারখানার তখন রমরমা অবস্থা। যদিও  স্যার বীরেন মুখার্জী ও তাঁর স্বনামধন্যা স্ত্রী, লেডি রানু মুখার্জী বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যেই কেবলমাত্র বার্ণপুরে আসতেন। কারখানার দায়িত্ব সামলাতেন মূলতঃ দুজন বিদেশী  — স্কটিশ প্রযুক্তিবিদ মি. ম্যাকক্রাকেন এবং জার্মান প্রযুক্তিবিদ মি. লামেয়ার। আর বার্ণপুরের সমাজ পরিচালিত হত কয়েকজন ফ্যাশানদুরস্ত আধুনিক মহিলার দ্বারা। এঁদের স্বামীরা যত দক্ষ প্রযুক্তিবিদই হোন না কেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন স্ত্রীদের হাতের পুতুল। এই মহিলাদের স্ব স্ব গোষ্ঠি ছিল এবং প্রায়ই তাঁরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন একে অপরকে টেক্কা দেবার জন্য। এই সব সান্ধ্য অনুষ্ঠানে সকলেই প্রায় উপস্থিত থাকলেও মি. লামেয়ারকে কখনই দেখা যেতনা। শোনা যেত তিনি সেসময় নিকটবর্তী দামোদরের তীরে কি একটা কাজে ব্যস্ত থাকেন। কিছুদিন পর ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। একদিন তিনি সবাই চমকে দিয়ে ঘোষণা করলেন যে দামোদরে ধারে একটি সুন্দর জিনিস তৈরী হয়েছে, সবাই যেন সময় করে দেখে আসেন। নিঃসঙ্গ জার্মান প্রযুক্তিবিদের কয়েক বছরের পরিশ্রমের ফসল হিসাবে দামোদরের ধারে ততদিনে তৈরী হয়ে গেছে এক মনোরম পার্ক। মূলতঃ ইস্কো কারখানার বাতিল জিনিস ও বর্জ্য পদার্থ দিয়ে তিনি তৈরী করেন তাঁর এই স্বপ্নের পার্ক। ব্লাস্ট ফার্নেসের ছাই ফেলে তৈরী হয় রাস্তা, পুরোনো পোড়া ইঁট দিয়ে তৈরী হয় দেওয়াল এবং ফার্নেসের বাতিল টিউব সারিয়ে বানানো হয় জলের লাইন। কয়েকমাসের মধ্যে পার্কটি এই অঞ্চলের একটি দ্রষ্টব্য স্থানে পরিণত হয়। পার্কটি তার স্রষ্টার নামে পরিচিত হয়। পরে যদিও তার নাম পরিবর্তন করে ‘নেহেরু পার্ক’ করা হয়, কিন্তু শিল্পাঞ্চলের মানুষ এখনও তাদের প্রিয় পার্কটিকে ‘লামেয়ার পার্ক’ নামে ডাকতেই বেশী ভালোবাসে।
  
এই রকম অনেক মজাদার গল্পে ভরপুর শিবরামকৃষ্ণানের স্মৃতিচারণাটি।  

ঋণ স্বীকারঃ
K.C.Sivaramakrishnan, The Enduring Babu: Memoirs of a Civil Servant, New Delhi, Har-Anand, 2009                                        

Thursday 1 March 2018

ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রামাণ্য আখ্যান রচনা করলেন বর্ধমানের এক ভূমিপুত্র, বদরুদ্দীন উমর





একুশে ফেব্রুয়ারী দিনটি দুই বাংলার মানুষের কাছেই ভীষণ প্রাসঙ্গিক, ছয় দশক পরেও। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর মানচিত্রে ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভোম রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে শরৎচন্দ্র বসু, সুরাবর্দী, আবুল হাসিমরা যে স্বাধীন বাংলার রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন তা যে অলীক কল্পনা ছিল না বাংলাদেশের জন্ম আমাদের সেই কথা মনে করিয়ে দেয়। দেশভাগকে মেনে নিয়ে এপার বাংলার বাঙালিরা সেই স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় সন্দেহ নাই। তবে ওপার বাংলার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতে আমাদের কোন বাধা নাই যখন দেখি ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রামাণ্য আখ্যন রচনা করেন বর্ধমানেরই এক ভূমিপুত্র, বদরুদ্দীন উমর। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর তিন খন্ডে  রচিত অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও দলিল সম্বলিত পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (১৯৭০) গ্রন্থটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চায় একটি প্রাথমিক ও অপরিহার্য গ্রন্থ। বিগত শতাব্দীর একজন অগ্রগণ্য ইতিহাসচিন্তাবিদ ইতিহাসের ছাত্রদের উপদেশ দিয়েছিলেন ইতিহাসকে বুঝতে হলে ঐতিহাসিককে জানা প্রয়োজন এবং তার জন্য প্রয়োজন তাঁর সময়কে জানা। তাই ভাষা আন্দোলনের এই আখ্যানকার কোন পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন তা জেনে নেওয়া দরকার।

বর্ধমানের একটি অত্যন্ত  সম্ভ্রান্ত, রাজনীতিমনস্ক পরিবারে বদরুদ্দীন উমরের (১৯৩১-) জন্ম। পিতা আবুল হাসিম ছিল অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের একজন প্রথমসারির নেতা। অসাম্প্রদায়িক, চিন্তাশীল, ইসলামীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষটি মুসলিম লীগে কিছুটা একলা হয়ে পড়েছিলেন শেষের দিকে। বাংলা ভাগ হোক এটা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। বস্তুতপক্ষে  অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার ধারণাটি ছিল তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁর নিকট আত্মীয়দের অনেকেই কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই রকম একটি রাজনৈতিক পরিবেশে বদরুদ্দীন উমরের বড় হয়ে ওঠা। পড়াশোনা বর্ধমান টাউন স্কুলে এবং পরে বর্ধমান রাজ কলেজে। দেশভাগের পর বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃত্বের একটি বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলেও তাঁর পিতা আবুল হাসিম সেই পথে পা বাড়াননি। তবে ১৯৫০ সালে তাঁদের বর্ধমানের বাড়িতে একদল দুষ্কৃতী আগুন লাগিয়ে দেয়। এই ঘটনায় তাঁর বাবা বিশেষভাবে ভেঙে পড়েন এবং দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। বদরুদ্দীনের বয়স তখন আঠারো। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন দর্শন নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখন ভাষা আন্দোলনে উত্তাল। তবে সেই আন্দোলনে তিনি যুক্ত হননি। ১৯৫৭ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৯-৬১ সালে তিনি অক্সফোর্ডে পড়তে যান যা ছিল তখন মার্কসীয় ইতিহাস চর্চার অন্যতম কেন্দ্র ইতিহাসের ছাত্র না হলেও তিনি যে ঐ জ্ঞানচর্চার পরিমন্ডলে প্রভাবিত হয়েছিলেন এ নিয়ে সন্দেহ নাই। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির একজন প্রথম সারির নেতা নেপাল নাগের, যাঁর উদ্যোগে তিনি দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ষাটের দশকে তাঁর সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৮)সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৮) নামে দুটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয় যার ফলে তিনি রাজরোষের শিকার হন। এর ফলে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরী ছেড়ে দিয়ে সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতিতে যোগ দেন।

ষাটের দশকের শুরু থেকেই তিনি ভাষা আন্দোলনের একটি তথ্য নির্ভর ইতিহাস লেখার ভাবনা শুরু করেন। ঐ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ না নেবার ফলে তিনি অনেকটা নির্মোহ অবস্থান নিতে পেরেছিলেন আন্দোলনের ইতিহাস রচনা কালে। ভাষা আন্দোলনকে তিনি নিছক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে দেখতে রাজী ছিলেন না। ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ববাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোটিকে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন। পূর্ববাংলায় তিনি ছিলেন নবাগত। সে কারনে তিনি এই কালপর্বটিকে বোঝার জন্য বহু মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেন। প্রথম সাক্ষাৎকারটি নেন কামরুদ্দীন আহমেদের। এর পর শতাধিক মানুষের সাক্ষাৎকার তিনি নেন যেগুলির নির্বাচিত অংশ পরে ঢাকা বাংলা একাডেমী থেকে দুখণ্ডে প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গঃ কতিপয় দলিল  (১৯৮৪, ১৯৮৫) নামে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে বেশকিছু বিভ্রান্তি শুরু থেকেই ছিল এবং এখনও আছে। ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের দাবিদারের সংখ্যা যে ক্রমশঃ বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। বিভ্রান্তি আছে আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি নিয়েও। সচরাচর এই আন্দোলনকে শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের আন্দোলন হিসাবেই দেখা হয়ে থাকে, সাধারন মানুষের ভূমিকা সেখানে নাটকের মৃত সৈনিকের মত। সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু ঐতিহাসিক এই প্রশ্নটি নতুন করে তুলেছেন। কেন অগণিত সাধারণ মানুষ যাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কেন স্কুলের চৌহদ্দিতেই পা রাখেনি এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল? যখন পূর্ববাংলার জনসংখ্যার ৮৫% মানুষি ছিন নিরক্ষর তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হবে তার সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ যোগ পাওয়া মুসকিল। এমনকি ভাষা শহীদদের মধ্যে কেবলমাত্র আবুল বরকত ছাড়া কেউই সেই অর্থে ছাত্র ছিল না। এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসার দিকনির্দেশ বদরুদ্দীন উমর ১৯৭০ সালেই তাঁর লেখায় দিয়েছেন। তিনি ভাষা আন্দোলনকে একটি বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসাবে দেখেননি। তাঁর বিশ্লেষনে ভাষা আন্দোলন ছিল পূর্ববাংলার ক্রমবর্ধমান সামাজিক সংঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। বদরুদ্দীন উমর দেখিয়েছেন যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি ১৯৫২ সালের ভাষা বিতর্কের সঙ্গে মিলে যার যার পরিণতিতেই ভাষা আন্দোলন একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এই মিলন ঠিক কিভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে নতুন করে চর্চা করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। বদরুদ্দীন উমর যেখানে শেষ করেছেন সেখান থেকেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন ধরণের চর্চা শুরু হতে পারে।

পূর্ব পাকিস্তান সরকারের খাদ্য নীতি, কৃষি পণ্যের মূল্য, আমলা ও পুলিসের আচার-আচরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল উর্দ্ধমুখী। ১৯৪৭ সালের পর খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারের কর্ডন ও লেভি নীতি কৃষকদের জীবন দুর্বিসহ করে তোলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পুলিস ও আমলাতন্ত্রের অত্যাচার। পুলিসি অত্যাচার কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছে ছিল তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে এই হিসাব থেকে। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার অছিলায় পুলিস জনতার উপর গুলি চালায় ১৯৪৮ সাল ৩৮ বার। ১৯৪৯, ৫০ এবং ৫১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৯০ বার, ১১০ বার এবং ৫০ বার। এই সময়কালে অসংখ্য বার পুলিস জনতার সংঘাতের দৃষ্টান্ত মেলে সরকারী নথিতে। স্বাভাবিক ভাবেই জনগনের কাছে পুলিস তার বৈধতা হারিয়েছিল। অন্য দিকে ১৯৫২ সালের প্রথম থেকেই পাটের দাম যেমন পড়তে থাকে তেমনি চালের দাম বাড়তে থাকে আগের বছরের মতই। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের  অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ভাষা বিতর্ককে কেন্দ্র করে এই ক্রমবর্ধমান অসন্তোষেরই বিষ্ফোরণ ঘটে। এই অসন্তোষের অভিমুখকে সরকার বিরোধী আন্দোলনের দিকে পরিচালিত করতে পূর্ববাংলার আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতা কর্মীদের ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য, আন্দোলনের ধরণ থেকেও যা পরিষ্কার। ভাষা আন্দোলনের সরকারী ইতিহাসে এদের ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তাই ভাষা দিবস উদ্‌যাপনের দিনে ভাষা আন্দোলনের এই আখ্যানকারকেও স্মরণ করা প্রয়োজন যাঁর শিকড় ছিল বর্ধমানের মাটিতে প্রথিতসেই শিকড়ের টানেই তিনি প্রায় নিয়মিত বর্ধমানে আসেন। বেশ কিছু কাল আগে তাঁর সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ হয়েছিল। বর্ধমানের কথা উঠতেই তিনি আবেগ আপ্লুত স্বরে বলে উঠেন, ‘বর্ধমানে এলে একধরনের ঘরে ফেরার অনুভূতি হয়’। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেও আঠারো বছর বয়েসে ছেড়ে যাওয়া বর্ধমান শহরকে তিনি ভুলতে পারেননি। মনে প্রাণে এখনও তিনি বর্ধমানের মানুষই থেকে গেছেন।

উচ্চশিক্ষায় টি-টোয়েন্টিসুলভ তাণ্ডবলীলা

সম্প্রতি জেলার ও রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অকৃতকার্যতার অস্বাভাবিক হার বৃদ্ধি প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের মাথাব্...